গান নদীর স্রোতে.......


পাপান.. মা চিৎকার করেন রান্নাঘর থেকে।  কিছুই না বিষয়টা তবুও একটা কথা আছে না না জানলে অনন্ত, মা'র তাই হাল।  কম্পিউটারের আমদানি সেই সময়েই।  বাপির কোম্পানির সূত্রে প্রাপ্ত জিনিসটি বড়ই সাধের।  শুধু তাই নয়... তার ইচ্ছেও পাপানকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর।  পাপান কি চাই তার খবর কে রাখছে !!

পাপান শুধু কম্পিউটারের ফ্লপিতে মন নিবদ্ধ করে।  তার নজর ফ্লপিতে কিকরে ডেটা থাকে।  বিষ্ময়!!! 

বাপির অবর্তমানে তার ফ্লপিতে হাত দেওয়াতো দূরের কথা কম্পিউটারের  সামনের টেবিলে যাওয়ার উপায় নেই।  চিৎকারের কারন পাপান কম্পিউটার টেবিলের কাছে গেছে।  বাপি ইঞ্জিনিয়ার, তার ছেলেরও ইঞ্জিনিয়ার মন হবে সেটাই স্বাভাবিক।  কিন্তু পাপানের ভাল লাগে গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস.... তার সবসময় মাথায় ঘোরে কবি সুকান্তের কথা, ভালবাসে গোগোলের এ্যাডভেঞ্চার, কপিলের লড়াকু ক্রিকেট, গাভাসকারের অভিজাত ব্যাটিং।  স্বপ্ন দেখে ভিভ রিচার্ড্স-এর মত রাজকীয় উপস্থিতির।  এসবেরও মাঝে ভোলে না স্কুলের ইংলিশ টিচারের বাংলা ক্লাস -- প্রথম শেখা, এ বয়সের নেই ভয়

সেই পাপানের ডাইরিই আজ ছেপে দিলাম..... 

  আমার আঠারোই পা রাখা নব্বইএর দশকের পাদানিতে পা দিয়ে।   কাজেই নব্বই-এর দশকের শুরু আমার টিন-টিন ভাবের প্রায় শেষ।  যথারীতি বাঙালীর আড্ডার প্রভাব পড়েছে রক্তে।  পাড়ার মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে মেয়ে দেখা, অল্পবিস্তর প্রেমের স্বপ্ন দেখা, দুনিয়া বদলে দেওয়ার বাতেলা দৈনন্দিন জীবনের নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা।  সেই সময় পাড়ার মোড়ের মাথায় সিগারেট হাতে হাবুদার ক্যাসেটের দোকানে শুনি উল্টো রাজার দেশে… তারপর চুপচাপ দাড়িয়ে শুনি রাজশ্রী তোমার জন্য, নীলাঞ্জনা।  তারই কিছুদিন পরে সুমনের এক কাপ চা-এ তোমাকে চাই।   

হ্যাঁ!  বাংলা গানের জীবনমুখীনতার শুরু।  পথিকৃত সুমন-নচিকেতা।  লড়াই ছিল দু-দলে কে বড়।  মাঝখান থেকে দেখা গেল গানই বড়।  একে একে গায়কের বান লাগল বাংলা ভাষায়.. হিন্দির বদলে বাংলা গানের শ্রোতার সংখ্যা বাড়ল।  বাঁচল গানের কলের কোম্পানি, বাঁচল কিছু মানুষের রুজি-রুটি।  

ভুলিনি তারই মাঝে অঞ্জন দত্তের বেলা বোস-এর কথা।  এত বছর পরেও না শুনেও মনে আছে 2 44 1139।  অনেক চেষ্টা করেছি সাহস জোগাড়ের এই নাম্বারে ফোন করার কিন্তু ফোন আর করা হয় নি।  যদি বেলা বোসের গলা শোনা যায় ভাবনাতে থেকে যায়।  শেষমেষ এক বন্ধু বিকেলে ঠেকে আড্ডায় এসে গুলতাপ্পি দিচ্ছিল- তার সাথে বেলা বোসের কথা হয়েছে।  সকলে আদেখলার মত গোগ্রাসে গিলেছি তার কথা।  পরদিনই পেপারে বেলা বোস সংক্রান্ত একটা বড় আর্টিকল বেরোলে আমরা সবাই চুপ।  সে বন্ধুতো প্রায় মাসখানেক ঠেকই মাড়ায়ই নি! 

একই সময়ে যুক্তিবাদীদের প্রবল প্রতাপ বাড়ছিল।  যুক্তিবাদ সবকিছু বদলে দেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে পা বাড়ায় বঙ্গে!  তারই সাথে শ্রমিক আন্দোলন।  সেই রকমই এক সম্মেলনে প্রথম পরিচয় প্রতুল মুখোপাধ্যায় নামের ও গানের সাথে।  তার ভয় পাস নে মা…., আমি বাংলায় গান গায়… এখনোও কাঁটা দেয় শরীরে। 

এক সন্ধেতে গান শুনছি ফুল ভ্যলূমে, রাজশ্রী তোমার জন্য।  বাপি তখনও বাড়ি ফেরেনি অফিস থেকে।  রাজশ্রীর জন্য সব কিছুই ত্যাগ করা যায় তখন।  বয়সটাই তো ভেসে যাওয়ার, ভাসিয়ে দেওয়ার।  দুনিয়া উল্টে-পাল্টে দেবার স্বপ্নতো ঐ বয়সেই দেখা যায়।  কলিং বেলের আওয়াজে টনক নড়ে।  বাপি!  টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে উঠি পড়াশুনো নামক বস্তুটির প্রতি ভালবাসা দেখাতে।  বাপি কিছু বলেন নি, এমনিতেই বাপি কথা কম বলেন।

রাত্তিরে শোবার আগে বাপি মাকে বলেন, "এখনকার জীবনমুখী তো আগেও ছিল।  কবে ছিল না? কেন যে আমার ছেলেটা ক্ল্যাসিক্যাল গানের ভক্ত হোল না।" 

এসবেরই ঠিক আগে "মিলে সুর মেরা তুমহারা…." টিভিতে হিট!  বাপির সাথে আমার ঝগড়া ভীমষেণ যোশী বড় না কিশোর কুমার!  অবোধ বালকের ধৃষ্টতা বাপি ক্ষমা করেছিল।    

সেই শুরু…. গান নদীর স্রোতে ভাসার। 

আজ নিজের খেয়ালে যখন ইউ টিউবে ভিন্ন-ভিন্ন বাংলা গান, অসমীয়া গান শুনি ভিরমি খাওয়ার জোগাড় হয়।  মনে হয় কত কিছুই তখন শোনা হয় নি… রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের টপ্পা, রজনীকান্তের গান, অতুলপ্রসাদী… কি নেয় লিস্টে।  প্রেমে পড়েছি পুরোনো বাঙলা আধুনিক গানের.. আর প্রেমে পড়েছি অসমীয়া ফোক গানের.. অসাধারন!!!  

এইতো গত রবিবার দুপুরে বাঙালীর প্রিয় মাংসের ঝোল আর ভাত পেট পুরে খেয়ে ঘুম।  কোথায় মনের কোনে দেখি রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গলায় নিধু বাবুর টপ্পা ভেসে বেড়ায় ঘরের চৌহদ্দিতে আর আমি পাশে বসে তবলায়।  ঘুম ভাঙে মেয়ের ডাকে…… কি গো কি এত বলছিলে… কি যেন এক বৌ???

বুঝতে অসুবিধে হয় না মেয়ে কি বলছে?  তার তো জানার কথা নয়- কাদের কূলের বৌ গো তুমি..।  হেসে গায়ে হাত বুলিয়ে দিই।   

ভাল লাগে.. ভাল লাগে ভেবে এখনোও যে গানের ভাষা তার সুর খুঁজে নেয় দেশ-কাল-সময় নির্বিশেষে।  ভুলতে পারি না নব্বই-এর দশক যা আমাকে গানের ভাষার সাথে পরিচিত করেছিল.. জেনেছিলাম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কাছে " সব মরণ নয় সমান ……." 

Comments

Popular Posts