থেমে নেই
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…… বহুল প্রচারিত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে। অলীকের স্ত্রীর প্রিয় গান ছিল। মাঝে মাঝেই গুনগুন করত আর ভরিয়ে তুলতো ঘরের আবহ। এক বিষাদ বেদনা কাতর স্মৃতি যেন তাড়া করে বেড়াত তাকে, কারন অজানা। আজ অলীকেও পেয়ে বসে ঐ গানটি - কারন জানা। খুঁজে বেড়ায় তার চিরসঙ্গিনীকে। এযেন পরশ পাথর খোঁজা। অলীক বোঝে না কোথায় হারিয়ে যায় সব, বোঝার চেষ্টাও করে না। প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো এখন হয় না, মেনে নিয়েছে অবশ্য উপায়ই বা কি আছে না মেনে। বাড়ির পাশের পেঁপে গাছের ফাঁক দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর ঘরে আলোর ফালি অলীকের মনের অন্ধকার দূর করার এক সুদুর প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু সোজা নয় ব্যাপারটা। অলীক জানে তাকে নিজেকেই এই পথ পেরোতে হবে কোনোও কিছু দিয়ে কোনোও কিছু ধরে কোনোও কিছুর বিনিময়ে এই পথ চলা যাবে না। এ পথ সোজা কিন্তু সোজা নয়, অলিতে গলিতে স্মৃতি ভিড় করে আছে মস্তিষ্ক নামের এক জটিল ধাঁধার মাঝে। তারও গভীরে হারিয়ে আছে হৃদয় মাঝারে। যেই না পরশের ছোঁয়া পায় জেগে ওঠে নিমেষে। এই তো গতকালের কথা এক দোকানে বন্ধুর মেয়ের বার্থ-ডে গিফট্ কিনতে গিয়ে চোখ পড়ল এক ঝোলানো স্কার্ট-এর দিকে, অবশ্যই ডিসপ্লেতে টাঙানো নয়। সুর কাটে সেল্স গার্ল-এর ডাকে। লজ্জার একশেষ। কি যে বলে ঠিক করে উঠতে পারে না অলীক। কি করে বোঝায় সব হারিয়েও হারায় না সব ভুলেও ভোলা যায় না সব অতীতও অতীত হয় না। কিছুতো বর্তমান থেকেই যায় আমাদের জীবনে। সময় থেমে যায় ব্ল্যাকহোল নামক মরণের কাছে।
অলীক থেমে গেছে, সময় তার এগিয়েও এগোয়নি। সবই এগোচ্ছে কিন্তু সে দাড়িয়ে। ভাল লাগে না আজকাল এমনকি লিখতেও আঁকতেও গাইতেও। বন্ধু-বান্ধবেরা সকলে যোগাযোগ করেও তল পায় না। শুধু সে তার নিজের জগৎটাকে ছোটো করে চলেছে। এযেন লাটাইএ সুতো গুটোনো। সকলের বকবকম ভাল লাগে না, কিন্তু ছেলের বয়স তো বেশি নয় সে তো বকবেই। তারই তো ছড়িয়ে যাবার বয়স, জানার বয়স-জানানোর বয়স। সেদিন বেশ বলল - কোনোও এক প্রশ্নের উত্তরে অলীক জবাব দেয় জানে না। ছেলে ততোধিক উৎসাহে ফিরিয়ে দেয় উত্তর, -তুমি জানো না হতেই পারে না। পাপা সব জানে। ঠিক তাই পাপা সব জানে, পাপাদের সব জানতে হয়। এমনকি ছেলেবেলার না শেখা রাইমসও জানতে হয়। এই তো সেদিন অলীক শিখল - " বিল্লি বোলে মিঁয়াও মিঁয়াও মুঝকো হুয়া জুখাম; চুহে চাচা চুরন দেদো জলদি হো আরাম। চুহা বোলা বাতলাতা হুঁ এক দাওয়া বেজোড়; আব আগে সে চুহে খানা বিলকুল হি দো ছোড়।" মনে পড়ে গেল ডাক্তারের কথা মিষ্টিটা খাওয়া একদম বন্ধ করে দিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অলীক আর ভাবে নাহ্ মিষ্টিটা ছাড়া হয় নি। সুগারটা না বেড়ে যায়। বাইরের আকন্দ গাছের দিকে নজর পড়ে - পাঁচিলের গায় শালিক পাখি দুটো একমনে প্রেম করে চলেছে। ওরাও কি শোনে গান, ওদেরও কি আছে সেই গান যা তাদের আবহ থমকে দিয়ে বলে - যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে? অলীক আর দাড়াতে পারে না, সরে আসে জানালার পাশ থেকে। তাকে শক্ত হতে হবে, লিখতে হবে, কাজ করতে হবে। সব কিছুর মাঝেও কোনোও এক স্মৃতি উষ্কে দেয় পুরোনো বহু স্মৃতি। সব ঝেড়ে ফেলা যায় না। কোনোওভাবেই না। যখন জাগার তখন জাগবেই। যখন চলে যাবার চলে যাবেই।
Comments