উপসারী
মা'র ওপর গোঁসা করে বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর যে খুব একটা ইচ্ছে ছিল তা নয়, সু-এর চাপে ঢোঁক গেলার মত অবস্থা আর কি। এই তো সেদিনের কথায় ধরা যাক না কেন..
রাত্তির হয়েছে। মা'র যথারীতি টিভির সামনে বসার নেশা, কিন্তু সু'র হিসাবে তা চলবে না। মিন্টির ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ডক্টর বাসু বলেছেন বাচ্চার সামনে টিভি একদম নয়। সেই নিয়ে তুলকালাম। রাত্তিরে নিঝুম বাড়ির রুপ দেখে বিশ্ব চমকে যায়---- মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সাথে সু, ওদিকে মা'র চোখে ঘুম নেই, বাপি ঘরে পায়চারি করছে। বুঝি সকলেই আমার অপেক্ষায় রয়েছে।
পা রাখতেই বাপি কাটা কাটা স্বরে বলেন--- তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বাড়ি ছাড়, শেষ বয়সে মেন্টাল পিস হারানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।
বিশ্ব নিরুত্তর। জবাব না দিয়ে দোতলায় শোবার ঘরে জামা কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ে। আজ ঘরে খাবে ভেবে উৎসাহিত ছিল, কিন্তু কি করে? কপালের নাম গোপাল!!
ভোরবেলা ঘুম ভাঙে দুজনের গুঞ্জনে, তাকিয়ে দেখে সু প্যাকিং-এ ব্যাস্ত। একবার চোখে চোখ ফেলে উত্তর আসে দাদা'র বাড়ি চললাম। নিজের বাড়ি, নিজের রোজগার হলে বোল। এখানে অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে নেই।
পাশ ফিরে দেখে মিন্টিও তৈরি। আধো আধো গলায় বলে " পাপা কাল না মাম্মামের সাথে দাদাই-আম্মার খুব ঝগড়া হয়েছে।"
মিন্টি.... জোর গলায় ডাক পাড়ে সু।
বিশ্ব ইশারায় চুপ করতে বলে মিন্টিকে। মিন্টি মিচকি হাসি দেয়। তার সব ব্যাথা-কষ্টের লাঘব করা হাসি।
সু-এর দোষ খুব একটা দেয় না। সে এসেছে সচ্ছল পরিবেশ থেকে, বিরাট কিছু না হলেও তার দাদার-বাবার থিতু রোজগার ছিল। তাদের আদরে বড় হওয়া মেয়ে। বাড়ির সাথে একপ্রস্থ লড়াই করেই তাকে বিয়ে করেছিল। ভাল কলেজে পড়া, ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স কেনই বা করবে তার মত আর্টস নিয়ে সাধারণ পড়া, অতিবসাধারণ চাকরি করা ছেলের সাথে জড়িয়ে পড়বে! সকলেই অবাক হয়েছিল। এমনকি সু-কে বিশ্ব বিয়ের আগে প্রশ্নও করেছিল।
উত্তর ছিল খুব সাদা-সাপটা, সকলেই যদি রাজা-রাজড়া বিয়ে করবে তাহলে সাধারনকে বিয়ে করবে কে মশাই ? সাধারনের মধ্যেই তো অসাধারন লুকিয়ে থাকে। তোমার মত কবিতা কজন লিখতে পারে। আমার রোজগার আছে তো।
সম্পর্ক আরোও গভীরতর রুপ নিয়েছিল সেদিনের পর। নদীও সমুদ্রের রুপ নেয় মিলনের পর। কিন্তু কবিতায় তো আর পেট ভরে না!
আজ তারা বিয়ে করেছে। মিন্টি আসার পর সু চাকরি ছেড়েছে। সচ্ছলতার সংসারে টানটান ভাব এসেছে। তার ওপর বাপি-মা'র সাথে মতবিরোধ। মিন্টি তাদের উপসারী সু-এর ভাষায়, কাজেই তারাই ঠিক করবে মিন্টির সবকিছু। বিশ্ব হাসে তার কথায়। বেশ সুন্দর কথাটা উপসারী, অর্থে কন্ভার্জেন্ট।
সু-এর বেরিয়ে যাবার পর একে একে মা-বাপি এসেছে তার কাছে। সকলেই তার নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মানুষের ধর্ম!!!
মা'র কথা হল তারাও তো মানুষ, মিন্টি যদি একটু তাদের সাথে টিভি দেখেই ফেলল তাতে কি ক্ষতিটা হল?
বিশ্ব কথা বলে না। চুপ করে থাকে। সে জানে এর উত্তর নেই। দিন বদলের সাথে বাচ্চা মানুষ করার পদ্ধতিও বদলে গেছে। মা'দের চেতনা বদলেছে। শিক্ষার সুফল বা কুফল তা বোঝে না তবে বদল যে হয়েছে মধ্যবিও জীবনযাত্রায় তা ঠিক। তার মনে পড়ে না বাপি কোনোও দিন স্কুলে গেছে কিনা তার বা দিদির সময়। মাস্টারমশাই-এর হাত ধরেই ভাল বা মন্দের জগৎ ঠিক করা। তার চোখ দিয়েই জগৎ চেনার শুরু। এখনতো বাচ্চার জন্য বাবাকে স্কুলে যেতেই হবে, সেখানে ফাদার্স ডে আছে, রয়েছে মাদার্স ডে। ভাল-- বাপ-মা'র সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেকালে মা যদিওবা বন্ধু হয়েছে, বাপ স্বপ্নেও নয়। এইতো কিছুই না বুঝে বাপি গতকাল রাতে অসম্মান করল, ছেলের অসম্মানটাকে গুরুত্বই দেওয়া হয় না।
তাড়াতাড়ি অফিস বেরোয়, ম্যাগাজিন-এর কাজ। প্রুফ দেখা, এডিট করা সব কাজই ছোটো প্রতিষ্ঠানে করতে হয় একলা হাতে। মাসের শেষে যা মেলে তাই সংসার চালানো দুষ্কর! কিছুদিন আগে চায়ের আড্ডায় দেবকিদাকে বলেছিল কথাটা। উনি জবাব না দিয়ে নিরুত্তর থাকায় শ্রেয় মনে করলেন। অর্থাৎ তার কিছু করার নেই। সত্যিইতো কিইবা সে করবে, বাংলা ম্যাগাজিনের চল তো অনেক কমেছে। এখন সকলেই ইংরেজি চ্যানেল - ম্যাগাজিন-এর প্রেমে মজেছে। তার বাড়িতেই বাদ নেই তো কাকে বলে।
" মিন্টির স্কুল ঠিকঠাক চাই। বাজারে কম্পিটিশান অনেক। " রাত্তিরে শোবার আগে মাখনের প্রলেপ গালে লাগাতে লাগাতে বলল সু।
বিশ্ব ঠিক চিনতে পারে না এই সু-কে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফেরে।
কি হোল উত্তর দিচ্ছ না যে বড়?
না ভাবছি দেবকিদার সাথে কথা বলব। ওর তো অনেক চেনা। যদি আরোও কিছু বইএর প্রুফ দেখার কাজ পাওয়া যায়।
" তুমি না সেই ভেতো কবিই থেকে গেলে। কেন একটু ম্যানিপুলেট করলেই তো বড় পাবলিসিং হাউসে হয়ে যেত। তোমার বন্ধু তুহিনকে দেখ, সে তো সেবারে বললও একটা ভ্যাকেন্সি রয়েছে। তুমি থাক তোমার ইগো নিয়ে-- উপন্যাস লিখব না।" সু এক ঝটকায় বালিশে টান মারে। শুয়ে পড়ে দুজনে দুদিকে মুখ করে। বিয়ের পরের ছ-মাস জড়াজড়ি, তারপরের ছ-মাস মাঝেমাঝে জড়াজড়ি; তার আর পরও নেই জড়াজড়িও নেই!
রাতভর জাগা চোখে পরদিন প্রুফ দেখতে বেশ সমস্যায় হয়েছিল। কিন্তু কি করে। ম্যাগাজিন সময়ে বার করতেই হবে। সে শুধু নিজে নয় আরও অনেকের ভবিষ্যতের রুজি-রুটি জড়িয়ে থাকে। বিকেলের দিকে অফিস ফেরতা তুহিনকে ফোন করেছিল।
কফি শপে বসে তুহিন সব শোনে... বাড়ির কথা, মা'র কথা, সু'র কথা, এমনকি বাপির কথাও বিশ্ব লুকোয়নি, যদিও তা একান্তই পারিবারিক বিষয়।
সব শেষে তুহিন বলে, তুই কাল একবার লাঞ্চ আওয়ার্স-এ অফিসে আসতে পারবি?
পরদিন নীরেনদা'র সাথে লাঞ্চ করতে বসে ভয়ই পায়... সে জানে না তুহিন সব বলে রেখেছে। ভারী গলায় নীরেনদা বলেন-- শোনো ভায়া আমি তোমাকে এখন চাকরি দিতে পারব না এই পাবলিশিং হাউসে তবে মাসে দুটো কবিতা বাঁধা। তোমার মত কবিরা কেন যে সময় নষ্ট করে। আরোও খানিক বিরতি নিয়ে তার ভারী শরীরের ধকল সামলে বলেন-- তুমি ছোটো গল্প লিখতে পারবে বলেই তো মনে হয়। শুরু কর না। নতুন কিছু আমরাও পাই।
খানিক নখ খুঁটে বিশ্ব উত্তর দেয় আজ তাহলে উঠি - অর্থাৎ ঠিক আছে।
দেবকিদাকে ফিরে সব খুলে বলেছিল। কোনোও উত্তর দেয় নি। খানিক পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। হতাশা, বিষন্নতা, কান্না সবই লুকিয়ে ছিল সেই ধোঁয়ার ফাঁকে। ভাবে আরোও একটা ম্যাগাজিনের উইকেট পড়তে চলল।
তার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হাসে। হাসিটার মধ্যে এক হার লুকিয়ে আছে। বিশ্ব দেখে কিন্তু কিছু বলে না।
রাত্তিরে সু'র বাড়ি এসেছে আজ সে। বিয়ের পর প্রেমে ভাটা পড়েছে তা বলা না গেলেও, বৌ ছাড়া ঘুম হলেও মিন্টির অবর্তমানে বিশ্ব খোঁড়া। কে জানে হয়ত পরে মিন্টির সাথেও সম্পর্কটা প্রোটোকলের মধ্যে আটকে যেতে পারে। আগামীদিন কে দেখেছে।
সু হাতের কাজ সেরে ওর রুমে যায়। বাপি-মা বাইরে গেছে, দাদা-বৌদিও কি এক অফিসের পার্টিতে বাইরে। মিন্টি ঘুমিয়ে পড়েছে। বিশ্ব চুপ, বিছানায় অপেক্ষারত যদি মান ভাঙানো যায়। কথাটা পাড়ে-- আজ নীরেনদার সাথে মিটিং ছিল, কথা হল লেখা নিয়ে। সুদিনই সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।
সু'র হাত থামে, হাতের ক্রিম হাতেই থাকে। ঘুরে তাকায় ঘাড় সোজা করে রাজহাঁসের মত।
এই রুপটা দেখার জন্য পাগল ছিল বিশ্ব এক সময়। এখনও উপভোগ করে তবে দূর থেকে।
কয়েকমাসের মধ্যে সংসারে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বাড়ি ছেড়ে নতুন ভাড়া বাড়িতে। জমানো টাকা সব নিঃশেষ করে টিভি, ফ্রিজ সব হয়েছে। মিন্টির স্কুলের এ্যাডমিশান করিয়েছে বেশ ভাল স্কুলেই। উইকএন্ড-এ মলের জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ হতে হয়েছে বিশ্বকে। আজ একটা সিনেমা দেখে রাত্তিরে খেয়ে ফিরেছে তিনজনে। মিন্টি রাস্তাতেই নিদ্রাদেবীর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আজ তাদের জীবনের স্পেশাল দিন। বিবাহ বার্ষিকী। এখন সে ছোটো পাবলিশিং হাউস ছেড়ে, দেবকিদাকে বিদায় জানিয়ে পার্মানেন্ট্লি হাত ধরেছে নীরেনদার। কপোত-কপোতীর প্রেমালাপ আবার পুরোনো দিনের মত। বকবকম, চোখে চোখ, হাতে হাত, শরীরের নরম স্পর্ষ সবে মিলিয়ে মিন্টি আসার আগের অবস্থা। কম্প্লেক্স-এ ঢোকার আগে ট্যাক্সিতে হাল্কাছলে সু' বলে মশাই আজ সারা রাত জাগরন। তৈরি হও। বিশ্ব ঠোঁটে মুচকি হাসি।
ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখেই দেখে দিলীপ দাড়িয়ে। মুখ শুকনো। এত রাত্তিরে।
দাদা আপনি তাড়াতাড়ি চলেন। দেবকিদা হসপিটালে।
মানে!!
হ্যাঁ দাদা, আপনি অফিস ছাড়ার পর থেকেই চুপ, কেমন শান্ত হয়ে গেছিল। শুধুই বলত -- আবার একটা উইকেট পড়ল!
সু পাশে দাড়িয়ে। জীবনের সুর-তাল কেটেছে।
তারপর....
আজ বিকেলে আমায় বলল এক কাপ চা বানা। কড়া করে বানাবি। ওনার ঘরে তো আপনি ছাড়া আর কারোও প্রবেশ ছিল না। চা আর খাওয়া হোল না। তার আগেই স্ট্রোক। আপনাকে অনেক ফোনে ধরার চেষ্টা করেছি। শুধু বিড়বিড় করছে বিশ্ব…
বিশ্ব ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখে অনেকগুলো মিস কল। ফোন সাইলেন্ট মোডে ছিল।
সু'র সাথে ইশারায় কথোপকথন সারে। তার মত গিয়ে দেখা। প্রায় ভোরে ফিরেছে বাড়িতে। সু' বারবার প্রশ্ন করেছে দেবকি'দা কেমন আছে। বিশ্ব নিরুত্তর।
বিকেলে নীরেনদার টেবিলের উল্টোদিকে বসে,
তুমি সব ভেবে বলছ, নীরেনদা বলেন।
মাথা না তুলেই ঘাড় নেড়ে সায় দেয় বিশ্ব।
ক্রিং..... বেল বাজে দ্রুত।
পিয়ন মুখ বাড়াতেই, দুটো কফি দিয়ে যা।
আবার মুখ ঘুরিয়ে বলেন, তাহলে তুমি আর এই হাউসে কাজ করবে না।
শুকনো মুখে বিশ্ব উত্তর দেয়, না। বেশ জোরের সাথেই।
নীরেনদা উঠে দাড়ান, বেশ কয়েকবার পায়চারি করে তার পাশের চেয়ার টেনে বসেন। প্রায় ফিসফিস করে বলেন, দেবকি কে বলবে যদি আমাকে ম্যাগাজিনটা বিক্রি করে। আমি চালাব। বন্ধ করব না। সব একই থাকবে।
বেশ খানিক চুপ থাকে বিশ্ব। মাথা নেড়ে বলে দেবকিদা রাজি হবেন না।
আহা। তুমি বলে দেখ না। অসুস্থ মানুষ। ডান হাত-বাম হাত নেই। তুমিই বা কত করবে। আচ্ছা চল আমি যাব দেবকির কাছে। কোন হসপিটালে যেন?
আমি এখন আসি। উত্তর দেয় বিশ্ব। তার ইচ্ছে নেই ম্যাগাজিন বিক্রি করার।
রাত্তিরে সু'র কোলে মাথা রেখে কেঁদেছে অনেকক্ষন। তার কবি সত্তা কি মরে গেছে! তার সততায় কি ভাটা পড়েছে! এই প্রশ্নই তাকে বিঁধছে।
সু মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, সব কেমন বদলে যায় না। গতকালই আমরা খুব খুশি ছিলাম নীরেনদার হাউসে প্রেস্টিজিয়াস কাজ, গল্প লেখা বড় হাউসে, লেখক পরিচিতি, সবই বড়- আর আজ! আরোও আশ্চর্যের কি জান দেবকিদা ও নীরেনদা দুই ভাই! নীরেনদার পাবলিশিং হাউস তাদের পারিবারিক ব্যাবসা। বাবার সাথে ঝগড়া করে দেবকিদা বাড়ি ছেড়েছিল। আর ও মুখো হয় নি।
উঠে বসে বিশ্ব, "তুমি কি করে জানলে?"
তুমি আসার আগে সুদিনদা ফোন করেছিল আমাকে। সব বলেছে। নীরেনদা তার মারফত বলেছেন তোমায় জানাতে ম্যাগাজিন বিক্রি করতে হবে না, দেবকিকে জানাতেও হবে না। তুমিই সব চালাবে। বিক্রি হবে নীরেনদার চেইন-এ। তাতে রাজি তো মশাই? কি গো? এবার সব ঠিক আছে।
শুধু উনি একটাই অনুরোধ রেখেছেন-- মাসে একটা কবিতা ও বছরে একটা উপন্যাস উনার প্রাপ্য।
উপন্যাস!!!
মাঝরাতে হাতের ঠেলায় সু-এর ঘুম ভাঙে। ঘুম জড়ানো চোখে সু বলে, কি হোল আবার।
ছোট্ট বাচ্চা আবদার করে, " মা'র কাছে ফিরে যাবে!"
সু হেসে ছোট্ট বাচ্চাটিকে বুকে টেনে নেয়। পাশে উপসারী মিন্টি।
Comments