একথা কেমনে বলি..


  তনুমা কে আজ দেখার সময় হয় নি সকাল থেকে।  সকলেই ব্যাস্ত।  প্রিয়া আড়াল হয় সকলের মাঝ থেকে। আজ গায়ে হলুদ।  ওপরের ঘরে তনুমা শুয়ে।  অসুস্থ মানুষকে সকলেই ভুলে যেতে চায়।  তনুমার তা নিয়ে ক্ষোভ নেই।  শুধু চুপ হয় মাটির মানুষের কথা ভেবে।  প্রিয়া আছে, কিন্তু সে কি সামলাতে পারবে।  নিজেকে নিয়ে ভাবনা হয় না।  তার চিন্তা শুধু মাটির মানুষকে নিয়ে।  ঈশ্বরের ওপর একটা চরম বিরুপ ভাব নিয়েই সে যাবে।  এভাবেতো যেতে চায় নি।  পাশ ফিরে জানালার দিকে চায়।  পায়রাগুলো যথারীতি এসে বসেছে।  সময় পেলেই বসে।  সাদা একটাতো আবার জানালা ছাড়িয়ে বিছানায় চলে আসে।  প্রায় পাশে এসে মুখ বাঁকিয়ে বলে- 

ভয় কি।  আমরা তো আছি।  সব ঠিক হয়ে যাবে।  তোর মাটির মানুষ নিয়ে চিন্তা করিসনি।

কি যে করে - লিভারের রোগ দানা বেঁধে বসেছে।  উঠতেও দেয় না।  খাওয়ার রেসট্রিকসান।  অসহ্য যন্ত্রনা।  মেয়ের বিয়েতে কিছু করারও উপায় নেই। 

তনুমা… ডাক শুনে পাশ ফেরে।  প্রিয়া।  বেচারির মুখ-চোখ শুকিয়ে একসা।  বেচারি! কেউ খাবার দিকে নজরই দেয় না বোধহয়।  দাড়াও আজ মাটির মানুষকে বলতে হবে।  উৎসাহ নিয়ে উঠে বসে- তোর বাপি কোথায়?

আর বোলো না।  সকাল থেকে বেরিয়েছে।  কানু কাকুর ছেলের আব্দার মেটাতে।  ক্যাডবেরি চাইই চাই।  অসম্ভব জেদ।

বাকিরা কি করছে? 

মেজ মা গেছে মন্দিরে।  ছোটো বাজার।  আর সেজোর তো জানই।  সাজতেই ব্যাস্ত।  মাঝে মাঝে কাকাদের দেখে রাগে গা জ্বলতে থাকে।  সবাই গিন্নিদের একদম তোল্লা দিয়ে রেখেছে।  

কাছে ডাকে তনুমা।  গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলে- হ্যাঁরে তুই খুশি তো।  বেনু আমার বড় ভাল ছেলে।  দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।  আমার থাকা না থাকায়..

বলার সুযোগ দেয় না প্রিয়া।  মুখ চেপে ধরে।  ওকথা বোলো না।  তুমি না থাকলে মাটির মানুষের কি হবে।  কে দেখবে?  তুমি তো জানো তার কেউ নেই।  সব থেকেও নেই।  সেই কবে তুমি এসেছিলে এবাড়িতে।  তার আর কোনোও চিন্তা ছিল না।  এখন কি হবে।

কেন বেনু আছে না।  

না মা।  মাগো এ বিয়ে ভেঙে দাও।  আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না।  ফুঁপিয়ে কাঁদে প্রিয়া।

কষ্ট করেই উঠে বসেছিল।  পেটে হাত পড়ে।  ব্যাথা শুরু হয়েছে।  সারা শরীরে এবার ব্যাথা ছড়াবে। এসময় মাটির মানুষই একমাত্র ভরসা।  ও এলেই সব ঠিক।  জানে আর বেশিদিন নেই।  প্রিয়ার বিয়েটার অপেক্ষায় ছিল।  এবার হলেই ডাক আসবে।  অনেকদিন তো হোল।  আর কেন?

মাটির মানুষের কষ্টটাওতো দেখতে হবে।  টাকার শ্রাদ্ধ!  কি যে এক মারণ রোগে ধরল।  সব শেষ করে দেয়।  তিলতিল করে জমানো টাকা।  সব শেষ!  আর কোথাও কিছু বেঁচে নেই।  সাহায্য করারও কেউ নেই।  সব যন্ত্রনা চেপে লুকিয়ে প্রিয়াকে বলে- যা বাপিকে একবার ডেকে দে তো।

এ-কদিন খাবারও ইচ্ছে নেই।  ডাক্তারবাবু বলেছিল- সময় আসন্ন।  সেই কাউকে জানায় নি।  এমনকি মাটির মানুষকেও নয়।  যদিও সে সবই জানতে পারে।  তার অজানা কিছুই নেই।  এমনিতে বোঝা যায় না ভেতরে অনেক কিছু লুকোনো আছে।  অবাক হয়েছিল সেইদিন।

রাতে বলল কাল বাড়িতে অঘটন আছে।  সকলকে খাইয়ে দিও তাড়াতাড়ি।  হ্যাঁ ঠিক।  দুপুর বারোটায় খবর এল জেঠশ্বশুর হসপিটালে।  আর নেই।

পরে চেপে ধরলে বলেছিল-  ও কিছু না, মনে হয়েছিল বলেছিলাম।  লেগে গেছে।

তলপেটে চাপ অনুভব করে।  বাথরুমে যেতে হবে।  এখন যদিও মাটির মানুষের হাত ধরেই যায়।  বাইরে গেছে।  কখন আসবে কে জানে।  নিজেই ওঠার উদ্যোগ নেয়। পা-টা একটু নড়ে যায়।  খাটের পাশটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়।  আর খেয়াল নেই।  

তনুমা ডাকে চেতনা ফেরে।  মাটির মানুষ দাড়িয়ে সামনে।  সেই হাসি-হাসি মুখ।  সরলতা ভরা।  চুলগুলোয় বয়সের ছাপ পড়েছে।  হাতটা বাড়িয়ে দেয়।  ধরতে পারছে না।  ছুঁয়েও ছোঁয়া যায় না।  অদ্ভুত অবস্থা।  কোথায় আছে বুঝতে পারে না।  পরিবেশ থমথমে।  সবকিছুই আছে অথচ কিছুই নেই।  মাটির মানুষও নিজেতে নেই।  থাকে কি করে।  তার ভেতরে তো তনুমা আছে।  পুরোটায় তো তনুমা।  আরতো কোথাও কিছুই নেই!

মাটির মানুষে মিলে গেছে তনুমা, কেউ না জানুক মাটির মানুষ জানে।    

Comments

Popular Posts