টপ সিক্রেট
রাত্তিরে শুয়ে ছেলেবেলার অলিতেগলিতে প্রায়ই ভেসে যায়। এযেন স্বপ্নের দেশ। সাদা পেঁজা-তুলো ভরা মেঘের দেশ। নিষ্পাপ! জটিলতা বিহীন। খেলার মাঠ। বৃষ্টিতে ভেজা। ফুটবল খেলা। কাদায় লটাপটি। পুটুস পাতায় চুল আঁচড়ানো। শালের জঙ্গল। ওরা কিছুই পেলনা। তাকায় ছেলের দিকে। ছেলে পাশেই শুয়ে। বড় হচ্ছে।
বাপ ছেলে বন্ধু। কাজেই নতুন বন্ধুর জীবনে আগমন সহজেই বোঝা যায়। বন্ধু না বান্ধবী কিসের বান বইছে ফোনের বিল থেকেই বোঝা যায়। বদলে গেছে, সব বদলে গেছে।
গত বছরেই বার্থ-ডেতে রাতে ডিনার টেবিলে বসে বলল, "পাপা ফোন চাই। পার্সোনাল।"
হেসে মেনে নেয়, যদিও জানে কাজটা ঠিক নয় তবুও। ছোটো ছেলে। ক্লাস এইট। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আগেই ওপেন করেছে। ফ্রেন্ড্সলিস্টে তাকে লড়াই করে জায়গা নিতে হয়েছে। এবার ফোন, শুধু পোস্ট পেইড কানেকশান্। লিমিট ফিক্স্ড। কনট্রোল রাখা উদ্দেশ্য নয়, ফোনের মাধ্যমে গতিবিধি ট্রেস করাই উদ্দেশ্য।
একবছর পেরিয়েছে। ছেলে ফোন পাল্টেছে তিনবার। সকলে বলে বখে গেছে কিন্তু সে বখতে দেখে নি। পড়াশুনায় কোনোও খামতি নেই। সকলের সাথে ব্যাবহারও মিষ্টি। শুধু গানের পোকা। বোঝে বাপ-মা'র জেনেটিক্স। ওটাই ঠিক করলেই বাকি সব হবে। প্রথাগত পড়াশুনার প্রোয়োজন জীবনে খুবই কম। এটা সকলে মানতে চায় না, সে মানে। আমাদের দেশে প্রথাগত পড়াশুনো শুধু হেল্প করে আসল পড়াশুনোর পদ্ধতির উপায় খুঁজতে। ছেলেকে নিয়ে নাসার বিজ্ঞানীর স্বপ্ন দেখে না। শুধু একটাই ভাবনা যেন মানুষ হয়। মানুষের মত মানুষ। বাকি সব এমনিই হয়।
জীবনে অনেক দেখে এই বোধ হয় মানুষ হওয়া জরুরি। সমাজের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে! ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার মধ্যবিত্তের পেশা। মধ্যমননের পেশা। এছাড়া অধ্যাপনা বা পড়ানো। ক্রমাগত সামাজিক অবক্ষয়ের মাঝে পেশাগুলি নিজস্ব শুদ্ধতা হারিয়েছে। পেশার দোষ নয়। পেশাদারের অবক্ষয়। বাপ-মা'র অবক্ষয়।
ছেলে অনীকের বন্ধু। আজ রাতে প্রশ্ন করে, " বাপি শঙ্কর কে?"
কে শঙ্কর?
আরে তোমার লেখার ক্যারেক্টার।
হঠাৎ!
আহা তুমি বলই না? ছেলে আবদারের ভঙ্গিতে বলে। আসলে আমার গার্লফ্রেন্ড রিয়ার বাপি বলেছে, " পাপুনের বাপির ছেলেবেলা ও শঙ্করের ছেলেবেলা একই।"
হেসে মাথায় হাত বোলায় ছেলের। অন্য প্রসঙ্গ তোলে, " তাহলে রিয়া তোমার গার্ল ফ্রেণ্ড!"
বাপি বল না। উই আর কিউরিয়াস টু নো। হাউ ডিড ইউ পোট্রে দোস ইমেজেস ইফ ইউ ডিডন্ট এক্স্পিরিয়েন্স।
উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙে। পা টানটান করতেই ছেলে উৎসাহী হয়। শুরু হয় শঙ্করের রহস্য।
শোন তাহলে একটা গল্প বলি। এ-আমার নিজের কথা। ছেলেবেলার কথা। ছেলেবেলার হিরোর কথা।
আমার স্কুল কম্পাউন্ড ছিল বেশ বড় ও হাবভাবও কলেজের মত। যার যখন ইচ্ছে আসে যায়। কোনোও বাধা নেই। সে এক মজার স্কুল। সকলেই রাজা। হেডস্যার থেকে জমাদার। স্টুডেন্টদের পোয়াবারো। আমার হিরো ছিল তারই মাঝে এক অদ্ভূত- কিম্ভুত।
গৌরীশঙ্কর। শ্যামলা, রোগা-পাতলা, কারোও টেরও পাবার জো নেই সে কি করছে বা করবে। বাবা বাইরে থাকার জন্য বিগড়োনোর সব উপাদানই তার জুটেছিল। স্কুলের সব টিচারেরই নিক নেম দেওয়া তার একটা রীতির পর্যায়ে পড়েছিল। তারই মাঝে এক বিশেষ নাম "লঙ্কা"। গৌরীশঙ্কর ছিল তার দুচোক্ষের বিষ। সুযোগ পেলেই তাকে ধরে অপমান এক নিয়মে পরিনত হয়েছিল। গৌরীশঙ্করও ছিল সেরকম। পড়ার নাম শুনলেই গায় জ্বর আসে তার। ক্লাস নাইনে ফেল করায় নাম-ডাক আরোও বেড়েছে। এখন সে সকলের দাদা কাম বন্ধু। আমারও।
সেদিন ক্লাসে যথারীতি লঙ্কা ক্লাস নিচ্ছেন। পিছু ফিরেছেন বোর্ডে লেখার জন্য। মিতুল লাফ দিয়ে চেচিঁয়ে উঠল। ব্যাগ ফেলে, জলের বোতল ফেলে এক যাতা কান্ড। তার লাফানো আর থামে না।
পাশ থেকে ঋত বলে, ঐ তো ব্যাংটা।
দিদিমনি সকলকে জিজ্ঞেস করলেও কোনোও উত্তর পায় না। যদিও সকলের তির একই দিকে - গৌরীশঙ্কর।
পরে জানা যায় পিছনের বেঞ্চ থেকে কেউ ব্যাং ছেড়ে দিয়েছিল তার শার্ট-এর ভেতর। কেইবা হতে পারে গৌরীশঙ্কর ছাড়া পিছনের বেঞ্চের।
আমার আর গৌরীশঙ্করের বাড়ি ছিল একই পাড়ায়। ঘরে ফেরার পথে জিজ্ঞেস করি - কি করেছিলে?
- বেশ করেছি। সেদিন লঙ্কার ক্লাসে মার খাওয়াল তাই আজ ক্লাসটাই করতে দিলাম না। কাল আবার করব।
- দিদিমনি যদি তোমার মাকে বলে দেয়।
- বলুক। মা কত মারবে। আমি ঠিক হব না। এবার ঠিক করেছি পালিয়ে বম্বে যাব। ওখানে অনেক ভাল। কত বড় লোকেরা থাকে। বড়-বড় বাড়ি আছে।
- কি করে যাবে?
- সে তখন দেখা যাবে খন।
একটু থামতেই ছেলে বলে - কি হলো? থামলে কেন?
উৎসাহ নিয়ে আবার শুরু বলি, বুঝলি পাপুন তারপর বেশ কয়েক মাস গৌরীশঙ্কর স্কুলে ছিল। হঠাৎ ভাগলবা। কোনোও খবর নেই।
- কি হোল পাপা… বল? তাড়া লাগায় পাপুন।
- তারপর আর কি গৌরীশঙ্করের মা মারা যায়। আমারও স্মৃতি থেকে দূরে সরে যায় সে।
সময়ের ফেরে আমিও বম্বে চাকরিসূত্রে। ভাবতাম গৌরীশঙ্করের কথা। যদি কখনও দেখা হয়। তোর মা তো আগে থেকেই বম্বেবাসী। সবে আমাদের বিয়ে কথা পাকা হয়েছে। টাকার সাচ্ছন্দ তেমন নেই তাই গাড়ি কেনা হয় নি। অটোরিক্সাতেই যাতায়াত। একদিন রবিবারের বাজার, তোর মা আর আমি প্রেম করতে বেরিয়েছি। প্রেমের তো আর সময় থাকে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে রাত্রি। অগত্যা রেস্তোরায় পেট পুরে বাড়ি ফেরা। বেশ ছিল দিনগুলো।
- পাপা ... সুর করে বলে পাপুন, বাট হোয়াট অ্যাবাউট গৌরীশঙ্কর। ইউ আর কিলিং মাই টাইম পাপা।
খানিক বিরক্ত হয়েই পাপুন বলে।
- ওকে। লেট মি টেল ইউ দা ফ্যাক্ট। গৌরীশঙ্কর বাড়ি থেকে পালিয়ে ওঠে হোটেলের কাজে। সেখান থেকে এক কর্তার পছন্দ হওয়ায় তুলে নিয়ে যায় বাড়ি। লোকটা ভালই ছিল তাই তাকে পড়ার কথা বলে। কিন্তু গৌরী বাউন্ডুলে। তার কি ভাল লাগে বাড়ির জীবন। পালায় সেখান থেকে। এপথ-সেপথ পেরিয়ে নানা ঘাঁতঘোঁত চিনে বাঁধা পড়ে আরেক গৌরীর হাতে। শেষমেষ বিয়ে।
- কিন্তু তুমি কি করে জানলে? সে এখন কোথায়?
- সে কথা থাক। শোন তোর মাম্মামের কথা।
সে ছিল এক বর্ষার রাত্তির। আমি আর তোর মাম্মাম বাড়ি ফিরছি। রিক্সা কিছুতেই পায় না। বৃষ্টি হচ্ছে বেশ। এক রিক্সাওলা দাড়িয়ে ছিল। কিছুতেই যাবে না। তোর মাম্মাম প্রায় জোর করেই চড়ে। সে ছিল ডাকাবুকো মানুষ। না শুনতে পছন্দ করত না।
যাইহোক কোনোওমতে রিক্সায় পৌঁছয় বাড়ির গেটে। আমাদের কম্প্লেক্সটা ছিল বড় কিন্ত বাড়িগুলো দোতলা। পাওয়ার নেই। অন্ধকারে মিটার দেখা ও পয়সা মেটানোর অসুবিধে বুঝে রিক্সাওলা লাইট জ্বালে ভেতরের। মাম্মাম টাকা বার করে আর আমি যথারীতি ফ্ল্যাটের গেটে।
- তারপর? তার সাথে গৌরীশঙ্করের কি সম্পর্ক?
- আহা শোন না।
সকালের পেপার হাতে চা'র কাপ নিয়ে জমিয়ে বাঙালীর আড্ডার আমেজ বম্বে শহরে পাওয়া যায় না। কিন্তু অভ্যাস যাবে কোথায়? তাই সময় কম থাকলেও চা'র বদলে কফির কাপ নিয়ে আমাদের দুজনের একপ্রস্থ আড্ডা চলত। সেদিন আমি বাথরুম থেকে বেরিয়েছি, তোর মাম্মাম কফি হাতে ব্যালকনিতে এমন সময় কলিং বেল বাজে। রান্নার লোক গৌরী। ঢুকেই তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগায়। সকাল বেলা সময় কম। দুজনেই অফিস যাব। তারই মাঝে হঠাৎ লক্ষ্য করি মাঝেমাঝেই আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে, যেন কিছু বলতে চায়। অবাক লাগে। আমি কোনোওদিনই কাজের লোকের সাথে সচ্ছন্দ নই তোর মাম্মাম তা ভালভাবেই জানত।
যাবার আগে তোর মাকে বলে, "মেমসাব এক বাত পুছু?"
হ্যাঁ।
সাব কা গাঁও কিধার হ্যায়?
কিঁউ?
নেহি, কাল মেরি আদমি বোলে কে পুছনা্ সাব কি ঘর কাফি বড়া হ্যায়। অওর এক বড়া আম কি পেড় ভি হ্যায় ঘরমে। তিসরে মালে পে এক ছোটা সা ঘর ভি হ্যায় সাব কা খিলোনা ভর্তি হ্যায় খেলনে কে লিয়ে।
আমি রেডি হচ্ছিলাম। হঠাৎ ওকথা শুনে বেরিয়ে আসি বাইরে, জোরে বলি তোর মাকে, "জিজ্ঞেস কর কি করে জানল? একি ম্যাজিক?"
গৌরী পাল্টা জবাব দেয়, সাব ও আভি নিচে হ্যায়। বুলায়ু। মেরি আদমি, শঙ্কর, রিক্সা চালাতা হ্যায়। কাল আপ দোনোকো ছোড় কে গ্যয়া রাতকো।
আমার ভেতরে হাজার বাতির আলো জ্বলে ওঠে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে পৌঁছতে এক মিনিট। হ্যাঁ অবিকল সেই, সেই মুখ পাতলা চেহারা। সময়ের দাপটের ছাপ চোখে-মুখে।
বাপ ছেলে বন্ধু। কাজেই নতুন বন্ধুর জীবনে আগমন সহজেই বোঝা যায়। বন্ধু না বান্ধবী কিসের বান বইছে ফোনের বিল থেকেই বোঝা যায়। বদলে গেছে, সব বদলে গেছে।
গত বছরেই বার্থ-ডেতে রাতে ডিনার টেবিলে বসে বলল, "পাপা ফোন চাই। পার্সোনাল।"
হেসে মেনে নেয়, যদিও জানে কাজটা ঠিক নয় তবুও। ছোটো ছেলে। ক্লাস এইট। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আগেই ওপেন করেছে। ফ্রেন্ড্সলিস্টে তাকে লড়াই করে জায়গা নিতে হয়েছে। এবার ফোন, শুধু পোস্ট পেইড কানেকশান্। লিমিট ফিক্স্ড। কনট্রোল রাখা উদ্দেশ্য নয়, ফোনের মাধ্যমে গতিবিধি ট্রেস করাই উদ্দেশ্য।
একবছর পেরিয়েছে। ছেলে ফোন পাল্টেছে তিনবার। সকলে বলে বখে গেছে কিন্তু সে বখতে দেখে নি। পড়াশুনায় কোনোও খামতি নেই। সকলের সাথে ব্যাবহারও মিষ্টি। শুধু গানের পোকা। বোঝে বাপ-মা'র জেনেটিক্স। ওটাই ঠিক করলেই বাকি সব হবে। প্রথাগত পড়াশুনার প্রোয়োজন জীবনে খুবই কম। এটা সকলে মানতে চায় না, সে মানে। আমাদের দেশে প্রথাগত পড়াশুনো শুধু হেল্প করে আসল পড়াশুনোর পদ্ধতির উপায় খুঁজতে। ছেলেকে নিয়ে নাসার বিজ্ঞানীর স্বপ্ন দেখে না। শুধু একটাই ভাবনা যেন মানুষ হয়। মানুষের মত মানুষ। বাকি সব এমনিই হয়।
জীবনে অনেক দেখে এই বোধ হয় মানুষ হওয়া জরুরি। সমাজের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে! ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার মধ্যবিত্তের পেশা। মধ্যমননের পেশা। এছাড়া অধ্যাপনা বা পড়ানো। ক্রমাগত সামাজিক অবক্ষয়ের মাঝে পেশাগুলি নিজস্ব শুদ্ধতা হারিয়েছে। পেশার দোষ নয়। পেশাদারের অবক্ষয়। বাপ-মা'র অবক্ষয়।
ছেলে অনীকের বন্ধু। আজ রাতে প্রশ্ন করে, " বাপি শঙ্কর কে?"
কে শঙ্কর?
আরে তোমার লেখার ক্যারেক্টার।
হঠাৎ!
আহা তুমি বলই না? ছেলে আবদারের ভঙ্গিতে বলে। আসলে আমার গার্লফ্রেন্ড রিয়ার বাপি বলেছে, " পাপুনের বাপির ছেলেবেলা ও শঙ্করের ছেলেবেলা একই।"
হেসে মাথায় হাত বোলায় ছেলের। অন্য প্রসঙ্গ তোলে, " তাহলে রিয়া তোমার গার্ল ফ্রেণ্ড!"
বাপি বল না। উই আর কিউরিয়াস টু নো। হাউ ডিড ইউ পোট্রে দোস ইমেজেস ইফ ইউ ডিডন্ট এক্স্পিরিয়েন্স।
উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙে। পা টানটান করতেই ছেলে উৎসাহী হয়। শুরু হয় শঙ্করের রহস্য।
শোন তাহলে একটা গল্প বলি। এ-আমার নিজের কথা। ছেলেবেলার কথা। ছেলেবেলার হিরোর কথা।
আমার স্কুল কম্পাউন্ড ছিল বেশ বড় ও হাবভাবও কলেজের মত। যার যখন ইচ্ছে আসে যায়। কোনোও বাধা নেই। সে এক মজার স্কুল। সকলেই রাজা। হেডস্যার থেকে জমাদার। স্টুডেন্টদের পোয়াবারো। আমার হিরো ছিল তারই মাঝে এক অদ্ভূত- কিম্ভুত।
গৌরীশঙ্কর। শ্যামলা, রোগা-পাতলা, কারোও টেরও পাবার জো নেই সে কি করছে বা করবে। বাবা বাইরে থাকার জন্য বিগড়োনোর সব উপাদানই তার জুটেছিল। স্কুলের সব টিচারেরই নিক নেম দেওয়া তার একটা রীতির পর্যায়ে পড়েছিল। তারই মাঝে এক বিশেষ নাম "লঙ্কা"। গৌরীশঙ্কর ছিল তার দুচোক্ষের বিষ। সুযোগ পেলেই তাকে ধরে অপমান এক নিয়মে পরিনত হয়েছিল। গৌরীশঙ্করও ছিল সেরকম। পড়ার নাম শুনলেই গায় জ্বর আসে তার। ক্লাস নাইনে ফেল করায় নাম-ডাক আরোও বেড়েছে। এখন সে সকলের দাদা কাম বন্ধু। আমারও।
সেদিন ক্লাসে যথারীতি লঙ্কা ক্লাস নিচ্ছেন। পিছু ফিরেছেন বোর্ডে লেখার জন্য। মিতুল লাফ দিয়ে চেচিঁয়ে উঠল। ব্যাগ ফেলে, জলের বোতল ফেলে এক যাতা কান্ড। তার লাফানো আর থামে না।
পাশ থেকে ঋত বলে, ঐ তো ব্যাংটা।
দিদিমনি সকলকে জিজ্ঞেস করলেও কোনোও উত্তর পায় না। যদিও সকলের তির একই দিকে - গৌরীশঙ্কর।
পরে জানা যায় পিছনের বেঞ্চ থেকে কেউ ব্যাং ছেড়ে দিয়েছিল তার শার্ট-এর ভেতর। কেইবা হতে পারে গৌরীশঙ্কর ছাড়া পিছনের বেঞ্চের।
আমার আর গৌরীশঙ্করের বাড়ি ছিল একই পাড়ায়। ঘরে ফেরার পথে জিজ্ঞেস করি - কি করেছিলে?
- বেশ করেছি। সেদিন লঙ্কার ক্লাসে মার খাওয়াল তাই আজ ক্লাসটাই করতে দিলাম না। কাল আবার করব।
- দিদিমনি যদি তোমার মাকে বলে দেয়।
- বলুক। মা কত মারবে। আমি ঠিক হব না। এবার ঠিক করেছি পালিয়ে বম্বে যাব। ওখানে অনেক ভাল। কত বড় লোকেরা থাকে। বড়-বড় বাড়ি আছে।
- কি করে যাবে?
- সে তখন দেখা যাবে খন।
একটু থামতেই ছেলে বলে - কি হলো? থামলে কেন?
উৎসাহ নিয়ে আবার শুরু বলি, বুঝলি পাপুন তারপর বেশ কয়েক মাস গৌরীশঙ্কর স্কুলে ছিল। হঠাৎ ভাগলবা। কোনোও খবর নেই।
- কি হোল পাপা… বল? তাড়া লাগায় পাপুন।
- তারপর আর কি গৌরীশঙ্করের মা মারা যায়। আমারও স্মৃতি থেকে দূরে সরে যায় সে।
সময়ের ফেরে আমিও বম্বে চাকরিসূত্রে। ভাবতাম গৌরীশঙ্করের কথা। যদি কখনও দেখা হয়। তোর মা তো আগে থেকেই বম্বেবাসী। সবে আমাদের বিয়ে কথা পাকা হয়েছে। টাকার সাচ্ছন্দ তেমন নেই তাই গাড়ি কেনা হয় নি। অটোরিক্সাতেই যাতায়াত। একদিন রবিবারের বাজার, তোর মা আর আমি প্রেম করতে বেরিয়েছি। প্রেমের তো আর সময় থাকে না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে রাত্রি। অগত্যা রেস্তোরায় পেট পুরে বাড়ি ফেরা। বেশ ছিল দিনগুলো।
- পাপা ... সুর করে বলে পাপুন, বাট হোয়াট অ্যাবাউট গৌরীশঙ্কর। ইউ আর কিলিং মাই টাইম পাপা।
খানিক বিরক্ত হয়েই পাপুন বলে।
- ওকে। লেট মি টেল ইউ দা ফ্যাক্ট। গৌরীশঙ্কর বাড়ি থেকে পালিয়ে ওঠে হোটেলের কাজে। সেখান থেকে এক কর্তার পছন্দ হওয়ায় তুলে নিয়ে যায় বাড়ি। লোকটা ভালই ছিল তাই তাকে পড়ার কথা বলে। কিন্তু গৌরী বাউন্ডুলে। তার কি ভাল লাগে বাড়ির জীবন। পালায় সেখান থেকে। এপথ-সেপথ পেরিয়ে নানা ঘাঁতঘোঁত চিনে বাঁধা পড়ে আরেক গৌরীর হাতে। শেষমেষ বিয়ে।
- কিন্তু তুমি কি করে জানলে? সে এখন কোথায়?
- সে কথা থাক। শোন তোর মাম্মামের কথা।
সে ছিল এক বর্ষার রাত্তির। আমি আর তোর মাম্মাম বাড়ি ফিরছি। রিক্সা কিছুতেই পায় না। বৃষ্টি হচ্ছে বেশ। এক রিক্সাওলা দাড়িয়ে ছিল। কিছুতেই যাবে না। তোর মাম্মাম প্রায় জোর করেই চড়ে। সে ছিল ডাকাবুকো মানুষ। না শুনতে পছন্দ করত না।
যাইহোক কোনোওমতে রিক্সায় পৌঁছয় বাড়ির গেটে। আমাদের কম্প্লেক্সটা ছিল বড় কিন্ত বাড়িগুলো দোতলা। পাওয়ার নেই। অন্ধকারে মিটার দেখা ও পয়সা মেটানোর অসুবিধে বুঝে রিক্সাওলা লাইট জ্বালে ভেতরের। মাম্মাম টাকা বার করে আর আমি যথারীতি ফ্ল্যাটের গেটে।
- তারপর? তার সাথে গৌরীশঙ্করের কি সম্পর্ক?
- আহা শোন না।
সকালের পেপার হাতে চা'র কাপ নিয়ে জমিয়ে বাঙালীর আড্ডার আমেজ বম্বে শহরে পাওয়া যায় না। কিন্তু অভ্যাস যাবে কোথায়? তাই সময় কম থাকলেও চা'র বদলে কফির কাপ নিয়ে আমাদের দুজনের একপ্রস্থ আড্ডা চলত। সেদিন আমি বাথরুম থেকে বেরিয়েছি, তোর মাম্মাম কফি হাতে ব্যালকনিতে এমন সময় কলিং বেল বাজে। রান্নার লোক গৌরী। ঢুকেই তাড়াতাড়ি কাজে হাত লাগায়। সকাল বেলা সময় কম। দুজনেই অফিস যাব। তারই মাঝে হঠাৎ লক্ষ্য করি মাঝেমাঝেই আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে, যেন কিছু বলতে চায়। অবাক লাগে। আমি কোনোওদিনই কাজের লোকের সাথে সচ্ছন্দ নই তোর মাম্মাম তা ভালভাবেই জানত।
যাবার আগে তোর মাকে বলে, "মেমসাব এক বাত পুছু?"
হ্যাঁ।
সাব কা গাঁও কিধার হ্যায়?
কিঁউ?
নেহি, কাল মেরি আদমি বোলে কে পুছনা্ সাব কি ঘর কাফি বড়া হ্যায়। অওর এক বড়া আম কি পেড় ভি হ্যায় ঘরমে। তিসরে মালে পে এক ছোটা সা ঘর ভি হ্যায় সাব কা খিলোনা ভর্তি হ্যায় খেলনে কে লিয়ে।
আমি রেডি হচ্ছিলাম। হঠাৎ ওকথা শুনে বেরিয়ে আসি বাইরে, জোরে বলি তোর মাকে, "জিজ্ঞেস কর কি করে জানল? একি ম্যাজিক?"
গৌরী পাল্টা জবাব দেয়, সাব ও আভি নিচে হ্যায়। বুলায়ু। মেরি আদমি, শঙ্কর, রিক্সা চালাতা হ্যায়। কাল আপ দোনোকো ছোড় কে গ্যয়া রাতকো।
আমার ভেতরে হাজার বাতির আলো জ্বলে ওঠে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে পৌঁছতে এক মিনিট। হ্যাঁ অবিকল সেই, সেই মুখ পাতলা চেহারা। সময়ের দাপটের ছাপ চোখে-মুখে।
সেই শুরু। প্রতি রবিবার শঙ্কর সকালে কিছুক্ষনের জন্য আসবেই। এখনোও আসে। কে বলত?
পাপুন জড়িয়ে ধরে বলে, " ড্রাইভার আঁঙ্কল!! তোমার ছেলেবেলার হিরো !"
ছেলেকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলে - ইয়েস, আমার হিরো। কেউ জানেনা। টপ সিক্রেট !
পাপুন জড়িয়ে ধরে বলে, " ড্রাইভার আঁঙ্কল!! তোমার ছেলেবেলার হিরো !"
ছেলেকে জড়িয়ে ফিসফিস করে বলে - ইয়েস, আমার হিরো। কেউ জানেনা। টপ সিক্রেট !
Comments