আবার - বারবার
মাঝ রাতে ঘুম ভাঙে সিধুর, নিশুতি রাতের জোছোনার শব্দে ঘেরা এই গ্রামের ফরেষ্ট বাংলোটি বড়ই ভাল লাগে তার। একপাশে হরিনের দল উল্টোদিকে গঙ্গার খাড়ি। বিকেলে আজ বেরিয়ে কয়েকটি খয়রা মাছ পেয়েছিল ক্যানেলের ধারে বসে বিক্রিবাটা করা মেছুনেদের কাছে। অলি খুব ভালবাসত, এখন অলি নেই কিন্তু ভালবাসার জিনিসগুলি রয়ে গেছে। এই জায়গাটা বেশ প্রিয় ছিল অলির। মাঝেমাঝেই জিদ ধরত তোমার অফিসের ছুটি নাও আমরা যাব। কোথায় বলার অপেক্ষা রাখত না। তার আগেই বলে দিত কার্তিকদাকে বলা আছে, বাংলো বুক করে রাখবে।
সেই গরমের ছুটিতে শেষ এসেছিল, তখনও অলির সাথে সম্পর্কে চিড় ধরে নি। হঠাৎই সব ঘটে গেল। কেন কি ব্যাপার প্রশ্নও করে নি কখনও। আসলে সিধুর ভদ্রতাবোধ শালীনতার মাত্রা বজায় রেখে চলে তা সে যতই কাছের হোক। সে নিজে শিল্পী মানুষ, নিজের স্পেশ বিষয়টা বোঝে। অলি বুঝত না। তুচ্ছ বিষয়কেও বাড়িয়ে তুলেছে অনেক সময়। এইতো গতবারের কথায় ধরা যাক না কেন। ধরীত্রির ফোনটা এসেছিল শুধু, কারনটা অফিসিয়াল, কোন রিভিউটা যাবে এটা ছিল জানার কথা। ব্যাস, শুরু হলো প্রশ্নত্তর পর্ব !!!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে টাওয়েল মাথায় রেখেই প্রশ্ন করে, " কার ফোন ? "
অফিসের বলে খান্ত হয় সে, শুধুই ধামাচাপা দেবার চেষ্টা। দেখেছে ধরী'র ফোন এলেই মুখ গোমড়া হয়ে যায়।
একবার কি এক কারনে বলেছিলাম, " না ধরী ওরকম নয় ও বেশ ভাল মেয়ে।"
তুমি কি বলতে চাও আমি খারাপ।
তা আমি কখন বললাম!!
হ্যাঁ তা বলবেই তো এখন আমি খারাপ হবই তো। সব পাওয়া হয়ে গেছে না! আর তো কিছুই বাকি নেই!!
সিধু চুপ করে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন ওঘর থেকে, শুধু বাইরে পা বাড়ানোর আগে মুখ ফস্কে বেরিয়েছিল, " ওহ অলি তুমি না শুধুই মাথা খারাপ কর।"
ফলাফল - সারা রাত্তির দুজনের কথা বন্ধ-খাওয়া বন্ধ-তাকানো বন্ধ; সিধু ভুলেও কখনও ধরীত্রির কথা পাড়ে না।
সচেতন সিধু তাই বেডে শুয়েই চোখ ফেড়ে দেখছিল অলির সৌন্দর্য্য, দেখছিল না গিলছিল, বিছানায় এখনও অলি মনোরম। ভরাট শরীরের বাঁকে-বাঁকে লুকিয়ে থাকা চমক, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও ধরে ফেলে নিজেকে।
দুজনে বিকেলে বেরিয়েছে, ঘুরেছে এবড়ো-খেবড়ো, এখনও দুজনে-দুজনার হাতে-হাত ধরে ঘোরা এনজয় করে পড়ন্ত বিকেলে। হাতের স্পর্ষে এখনও শরীর কথা বলে, মন কথা বলে দুজনার। এযেন নিশ্তব্দে বাক্যালাপ।
সন্ধে পড়ে আসায় দুজনে বসেছিল ঘাটের বাঁধানো চত্তরটায়। হাতে চায়ের কাপ। বিয়ের চারবছর পেরোলেও মাখমাখ প্রেমের তাড়না থেকে মুক্ত হতে পারে নি দুজনের কেউই যদিও সিধুর প্রেম স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে কাজ করে। এখনও ঠিক করে উঠতে পারে না তার প্রেমের মানুষ কি এক না বহু। এই যে অলি রাগ করে ধরীত্রির ফোন এলে কথাটা তিলপরিমান হলেও ফেলে দেওয়ার নয়। সিধুর নিজেরই নিজেকে ভয় হয়। এইতো সেদিন অফিসে লেট নাইট হচ্ছিল শুধুই দুজনে ব্যাস্ত ইভেন্ট রেডির লাস্ট প্রেপ নিয়ে। মুহুর্তে ভুলে ছিল ধরীত্রির চপলতায়। বেশিদূর এগোনোর সাধ্যি হয় নি শুধুই একটু হাতে-হাত, আলগা ছোঁয়া-আলগা হাসি- আলগা ভাব ছাড়া। এসবই মধ্যবিত্তের বিবেকের তাড়না। এই বিবেকের তাড়নায় কতই না সুন্দরী শুধুই অধরা সুন্দরীই রয়ে গেল তার ইয়ত্তা নেই! রাত্তিরে অফিস থেকে বেরোনোর সময় সিধু ধরীত্রির কাছে পলকে আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেছিল! ভাল না এটা ভাল না!!
" দেখেছ " শব্দে তাল কাটে। অলি আঙুল উঁচিয়ে দেখায় দুটো অল্প বয়সি ছেলে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল খাড়ির জলে নৌকো নিয়ে, তাদের দুজনের দিকে আকারে-ইংগিতে দেখার উৎসাহ দেখেই অলি হাত দুটো জড়িয়ে ধরে। এটা তার বহুদিনের স্বভাব- বলে জ্বলছে যখন আরোও জ্বলুক।
" ম্যাডাম " ডাকে লজ্জা পায় অলি। হাতটা চট করে আলগা করে জোড় থেকে। কার্তিকদা এসে হাজির।
আরে কার্তিকদা যে,আসুন-বসুন, চা খাবেন নাকি? অলি উঠে যায় চা'র ব্যাবস্থা করতে, ফেরে থমথমে মুখ নিয়ে।
গড়বড় বুঝে প্রশ্ন করে সিধু, " কি হলো? "
তুমি আমাকে লুকিয়েছ?
কি?
ধরীত্রি ফোন করেছিল, কিন্তু তুমি বললে অফিসের। কাল তোমার অফিসের সকলের সামনেই তুমি বলেছ কোথায় আসছ? বেশ মিষ্টি সুরে বলছিল বৌদি আমরা সবাই জানি, আমিতো জানিই... সবাই বলে আমি অলীকের, মানে স্যারের এ্যাসিস্ট্যান্ট।
তো!! ওতো কলিগ, তাই বলেছি অফিস থেকে কল এসেছিল। এতে দোষের কি হলো?
অলি সুর চড়িয়ে বলে, " বাব্বা আবার অলীক... এখন স্যার উঠে গেছে। " খানিক থেমে মুখ ভেংচিয়ে বলে, " আমি তো অলীকের এ্যাসিস্ট্যান্ট!!! আদিখ্যেতা দেখ ধিংগী মেয়ের। মেয়ে নয় তো রাক্ষুসী-ডাইনি-চুড়েইল। "
নিমেষে রোমান্টিকতা বদলে সন্ত্রাসবাদ ঘিরে ধরল আমাদের। শুরু হলো অলির চুড়ান্ত অসম্মান পর্ব। কার্তিকদা বেচারা শেষমেষ পালিয়ে বাঁচলেন চা খাওয়া থেকে। আর সিধু ডুব দিল বিষন্নতায়।
আজ একবছর বাদে সেই একই জায়গায় বসে চাঁদনি রাতে ধরীত্রির হাতে-হাত রেখে সিধু। মন-শরীর-রমান্স সব মিলিয়ে এক রসায়ন, প্রেমের রসায়ন। কামনার রসায়ন। শরীরি তাড়নার রসায়ন।
বেশ জায়গাটা না সিধু ? ধরী গলার স্বরে রোমান্টিকতার ছোঁয়া। আধো-আধো সুরেলা গলায় বলে - সিধুউ...... মাই ডার্লিং..। ছদ্দ আল্লাদে মাতে তারা দুজনে। ধরী ছেলেমানুষি ভালবাসে।
হ্যাঁ। সিধু হালকা উত্তর দেয়।
আচ্ছা অলি তোমার প্রথম প্রেম না?
হ্যাঁ।
কি হলো? কথা কম বলছ?
সিধু নিরুত্তর না থেকে কথার পিঠে কথা পাড়ে, " না কিছু না। "
তুমি একবারও আমাকে আদর কর নি... হাত দাও নি ... ভালবাস নি..। ধরী উঠে এগোয় জলের দিকে। খানিক জলে পা রেখে দুলোয়। বোঝে ভাল লাগছে না। সব মিলিয়ে ভাল লাগার আবেশ থাকলেও হারিয়ে যেতে পারছে না। সিধু অন্যমনস্ক। জল ছেড়ে উঠে আসে আবার সিধুর কাছে। হাতে-গায়ে হাত বুলিয়ে ধরীত্রি কথা বলে। আজ দুজনে একসাথে রোমান্টিক রাত্তির কাটানোর সব ছাঁচাই ঢেলে সিধুকে জাগাতে চাইছে সে।
ধরীত্রি নিঝুম রাত্তিরের অন্ধকারে এই খোলা আকাশের নিচেই শরীরি খেলায় মাততে চায়, কাছে সরে বসে সিধুর। জড়িয়ে ধরে শরীরের ওম ছড়াতে চায়, হাত চুলে বিলি কাটতে-কাটতে নেমে আসে, কানে-মুখে আলতো করে ঠোঁটের ছোঁয়ার জাগাতে চায়। হাত নামিয়ে এগোয় শরীরী আবেশে মাতবে বলে।
আহঃ সর! এক ঝটকায় সিধু উঠে পড়ে। পারে না সিধু - এ তাদের প্রেমের ঘর, বাসর ঘর! এখানে শুধুই অলি'র বাস।
কি হলো ? আধো-আধো সুরে গলা জড়িয়ে ধরী প্রশ্ন করে।
সিধু চুপ। অন্ধকার রাত্তিরে নিরুত্তর থাকাই উত্তর। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। তার মাথায় ভাসছে - " এটা আমাদের একান্ত ব্যাক্তিগত জীবন। আমি তোমার অফিস নিয়ে মাথা ঘামায় না, কিন্তু আমাদের ব্যাক্তিগত জীবনেও তোমার অফিসের ধরী কেন? " অলির কথাগুলো একের পর এক ভেসে ওঠে। এমনকি কার্তিকদা, তার একান্ত অনুগত, সেও ঠিক চোখে-চোখ মিলিয়ে কথা বলে নি এবার।
ধরীত্রি রাগ করে উঠে চলে গেলে সিধু অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে জলের ধারেই সাথে অলির স্মৃতি। ঘুম ভাঙলে খোঁজ করবে অলির... আবার।
Comments