আধ্যাত্মিকতা ও আমরা

অনেক সময় মানুষের জীবন থেকেও না থাকা বোধ হয়। সকলের মাঝে থেকেও না থাকা, জেনেও না জানা, ভেবেও না ভাবা এই শব্দগুলো আদি-অন্ত মানুষের সাথে জড়িয়ে আছে গতকয়েকদিনের নিউজ্পেপারের খবরের দিকে চোখ রেখেই বোধহয় এই লেখাটি। মনের মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। খারাপ-ভাল মিলিয়ে মিশিয়ে। একসময় কলকাতায় লোয়ার সার্কুলার রোড ও তাকে ঘিরে একাকী বাড়িগুলো দেখে নানান ভাবনা বাসা বাঁধত। এমনকি সময়-সময় মানুষের সাথে নানান আলাপচারিতায় এই প্রসঙ্গ এসেওছে - দুধরণের মানুষ সৃষ্টিশীল হয়; এক - যাঁরা জীবনের নানান সমস্যায় ভুগে আধ্ম্যাতিক পরিমন্ডলের মধ্যে এসে পড়ে অজান্তে ও সৃষ্টির নেশায় মাতে, দুই - যাঁরা সমস্যাহীন থেকে একাকিত্বের জাল থেকে বেরোতে না পেরে সৃষ্টির নেশায় বাঁধা পড়ে। যেকোনোও সৃষ্টিই অসাম্য থেকে সাম্যে আসার একমাত্র পথ। কেউ গান করছে, কেউবা লিখছে, অথবা কেউ ম্যাথস্-এর প্রব্লেম সল্ভ করছে তিনজনেই একইসময়ে একই কাজ করে চলেছে, তা আর কিছুই নয় বাইরের সমস্যার সমাধানের ছলে ভিতরের সমস্যার সমাধান। আধ্ম্যাতিকতা যদি বিজ্ঞান হয় তাহলে প্রচলিত ধর্ম, গান, লেখা, আঁকা, তন্ত্র-মন্ত্র এসবই অ্যাপ্লিকেশান অফ নলেজ। অ্যাপ্লিকেশান দুধরণের হতে পারে সমাজের নিরিখে - পজিটিভ ও নেগেটিভ। যে যেপথ নেয়। তবে প্রয়োগসিদ্ধি অতিঅবশ্যই দরকারি।
দিনকয়েক আগে এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, নামটা আর উল্লেখ করলাম না। তবে জ্যোতিষের ঠেলায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। কেউ বলে এ-কথা তো কেউ সে-কথা। এছাড়াও টেলিভিশানের চ্যানেলগুলিতে সার্ফ করলে বা ইউটিউবের চ্যানেল-এ সার্ফ করলে দেখা আধ্মাত্যিক গুরুদের প্রবল প্রতাপ। সকলেই ঈশ্বর দর্শণ করেছেন এবং করিয়ে দেবেন। সারাদিনে কতই না মানুষ এর ফাঁদে পড়ে জাগতিক ও আত্মিক জীবনের উন্নতি আটকে ফেলেন তার ইয়ত্তা নেই। সরল সত্যটা খুব কম মানুষই বলেছেন - প্রয়োজন ও চাহিদা এই দুই-এর তফাৎবোধ ভীষণ জরুরি। যে পারে সে জেতে জীবন পথে।
একটা কথা বারবার আমাদের জীবনে ফিরে আসে - নিজেকে খোঁজা। অনেকেই একথাটা বলে চলেছেন - আমি কে তা বের করে জীবনে চল। এই ছোট্ট কথার নানান মানে বের করে আনাই যেতে পারে, কিন্তু সহজভাবে যদি দেখি আমার জীবনে ঠিক কি করলে আনন্দ পাই সেটাই আমার কাজ। কাজ সঠিক ভাবে অর্থে সৎভাবে করলে যেখানে পৌঁছনো যায় তাই আমি। এর বেশি জাগতিক মানে বের করার চেষ্টা নিশ্চিত জীবনের সাম্যতা নষ্ট করে। কথায় আছে অধিক সন্যাসীতে গাজন নষ্ট, আমি বলি অধিক ভাবলে সব নষ্ট। ভাবা ও কাজ এই দুই ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কাজহীন ভাবনা কিছুই দেয় না জাগতিক জীবনে।
অলৌকিক এই শব্দটির ওপর শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে অদ্ভুত এক টান রয়েছে। আমরা সকলেই সেই ছেলেবেলা থেকে অতিজাগতিক কিছু সবসময় আশা করে থাকি। তারই এক ফসল ব্ল্যাক ম্যাজিক চিন্তায়-চেতনায়। জীবনের সাপেক্ষে এই মানবসভ্যতা নিতান্তই নগন্য, তার জন্মলগ্ন থেকে সে শৈশব পেরোয়নি বলা চলে। অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে এব্যাপারে তবে নানান চিন্তার স্তর মানুষের চেতনায় বদল ঘটিয়েছে ও ক্রমাগত সভ্যতা এগিয়ে বা পিছিয়ে চলেছে চিন্তার বৈচিত্রতায়। কেউ বলেছেন মস্তিষ্কের বিভাজন, কেউবা স্থির বিশ্বাসে অটল হৃদয় বড়। সে যাই হোক না কেন - এই দেহ একাধারে রিসিভার ও ট্রান্সমিটার এই বিশ্বাস না এলে বাকি আধ্যাত্মিকতার পথ পরিষ্কার হতে পারে না। সুফীইজম্ বা মিস্টিসিসম্-এর ব্যাখ্যা হতে পারে না। সমর্পণ শব্দটির গভীরতা মাপা যেতে পারে না। কারণটা খুবই সরল - বিশ্বাস ছাড়া গ্রহণ ও প্রেরণ দুইই সীমিত।
আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা একমাত্র কর্মে। নিষ্কর্মা জীবন নিজের ও অন্যের আধ্যাত্মিক বিকাশের বাধারুপেই দাড়ায়। শুধুই রিসিভার হওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি শুধুই ট্রান্সমিটার একান্তই নয়। দুই-এর সাম্যই আধ্যাত্মিকতার স্বরুপ। প্রয়োগসিদ্ধিই যোগীর একমাত্র সাধনা !

Comments

Popular Posts