সময় পথ
ঘ্যঁাচ করে ব্রেক কষল ঋষি। মেয়েটা একেবারে সামনে। ক্রসিং-এর লাল লাইটে গান বাজছে
যদি তারে নাই চিনি গো ……..।
মুহুর্তে পরিবেশটা বদলে গেল। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কপর্োরেট অফিস। তাও আবার মারকেটিং। চাপ-এর শেষ নেই। ড্রাইভ করতে-করতে কালকের প্ল্যানটার মেন্টাল ম্যাপিং চলছিল। এক ধাক্কায় সব ওলোট-পালোট। বহুদিন বাদে একটি সরল নিষ্পাপ মুখ দেখল। তাও আবার এই ব্যস্ত মেট্রো শহরে। রাত দশটায়! এই পাড়ায়!
একবার ভাবে উইন্ডো-গ্লাসটা নামিয়ে কথা বলে। কিন্তু কি ভেবে আবার গিয়ার চেঞ্জ করে এক্সিলেটরে পা রাখে। যদিও মেয়েটি শেষে একটি মিস্টি লাজুক হাসি দিয়ে রাস্তার ওপারে গেছে।
গাড়িটা পাকর্ করে সবে ফ্লাটে পা রেখেছে, তিথির ফোন।
- হাই, হাউ ওয়াজ দা ডে?
- সো সো। অ্যাকচুয়ালি আ এম গোয়িং ফর বাথ। উইল কল ইউ ব্যাক।
ফোনটা কেটে সোফাতে গা এলিয়ে দেয় ঋষি। আজ এই মুহুতর্ে কারোও সাথেই কথা বলার ইচ্ছে নেই। মনটা শুধু মেয়েটির মুখ ও তাকে ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন কল্পনার কোলাজ বুনতে ব্যস্ত।
কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলে- এভরিথিং অফ মাইন ইজ নট মাইন, আনটিল আই গিভ ইট টু ইউ। অবচেতনে ডুব দেয় সে ছেলেবেলায়। তার খেলার সাথী তিতির। ভীষ্ন ছটপটে, লম্বা-লম্বা হাত-পা, ফসর্া, টানা-টানা চোখ। তুচ্ছ কারনে ঝগড়া- বেড়াল বাচ্চাটা কার! সেই শেষ। আর কথা হয়নি। তখন ক্লাস ফাইভ হবে। কিছুদিন বাদেই বাবা-মার হাত ধরে শহরছাড়া। সেই যোগাযোগ আজও বিচ্ছিন্ন। ফেসবুকে বহুবার চেষ্টা করেছে খোঁজার। কিন্তু না, ভাল নামটাই যে ভুলে গেছে।
রুমে আলোর পরিমানটা বাড়তেই ঋষি দেখে দূরে টেবিলের ওপর রাখা ডেস্কট্প-এ মেসেজ ভেসে ওঠে- টাইম টু টেক মেডিসিন। নিজের মধ্যে ফিরে আসে। আড়মোড়া ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকায়- কোয়াটর্ার টু টুয়েল্ভ। একটু চমকেই ওঠে। প্রায় দেড়ঘন্টা সোফায় কাটিয়েছে। দ্রুত বাথরুমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
টেলিফোন শাওয়ারটা দিয়ে ভাল করে নিজের সমস্ত নেগেটিভ ভাইভ্স ধুয়ে-মুছে সাফ করে। শেষমেষ বাথরুম থেকে বেরিয়ে বেশ আরাম বোধ করছে। অল্প-সল্প খিদেও পাচ্ছে। ফ্রিজটা খুলে গোটা দুয়েক প্যাস্ট্রি সাবাড় করে।
শোওয়ার আগে মেইলবক্স চেক করা বহু পুরোনো অভ্যাস। মেয়েটির চিন্তা ফের চাগাড় দেয় তার মনে। ভেসে আসে তিতির-এর কথাও। ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মেয়েটির সাথে তিতির-এর সম্পর্কটা কি। ডেস্ক-এর ওপর রাখা কালারড পেন্সিল হাতে তুলে নেয়। সাদা কাগজের ওপর শুরু হয় আঁকি-বুকি।
পরদিন সকালে একটু লেট করেই অফিসে ঢুকেছে। করিডোর-এ ঢোকার মুখেই প্রতীক বলে- হাই, এভরিথিং ফাইন।
- হ্যঁা, বিট টায়ার্ড।
- বস খোঁজ করছিল।
ঋষি কাঁধ ঝাকিয়ে নিজের কেবিনের দিকে এগোয়। আজ কপালে ঝাড় আছে। শুকনো ভাষন শুনতে হবে। ল্যাপটপ-এর ব্যাগটা ডেস্ক-এ রেখে এগোয় সবরকমের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে।
- হাই ঋষি, প্লিজ টেক দা চেয়ার।
ঋষি বাক্য বিনিময় না করে চেয়ার টেনে বসে।
- প্রেজেনটেশান রেডি?
- নো স্যার, বাই হাল্ফ-এন-আওয়ার ইউ উইল হ্যাভ ইট।
- ঋষি, ইট ইজ নট আ চ্যারিটেবিল ট্রাস্ট। কাল রাত্তিরে কি পার্টি হচ্ছিল। ফোন বন্ধ। আজ লেট।
ঋষি একটু অবাক হয় কথাটা শুনে। পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখে সত্যি-ই বন্ধ। অন করতে গিয়ে বোঝে চার্জ নেই। স্যরি বলা ছাড়া কোনও গতি নেই।
- প্লিজ গেট ইট ডান।
কেবিন থেকে বেরোনোর সময় কানে আসে- আ হ্যাভ লট অফ এক্স্পেকটেশানস ফ্রম ইউ। ঋষি আর ঘুরেও দাড়ায় না। জানে ঘুরলেই ভাষন-এর পরিমান বাড়বে।
নিজের কেবিনে বসে কাজে ডুব দেয়। মাথার ওপর অজস্র চাপ। সময় কোথায় হারিয়ে যায় নিজেও টের পায় না। লাস্ট অফিস মিটিং সেরে বেরোল রাত ন-টায়। বেসমেন্ট-এ এসে কাল রাতের অসম্পূর্ন কাজটা শেষ করার ঝোঁক চাপে। দ্রুত গাড়ি বের করে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাস্তায় আইন গর্হিত অর্থাত মোবাইল-এ মার সাথে কথা, তিথির সাথে কথা সেরে নেয়। এই দুটিই তার জীবনের গুরুত্বপূনর্ জায়গা। যদিও তিথিকে কখনও তিতির-এর কথা বলা হয় নি। নিজের এই গোপনতম বিষয়টি ভেতরেই রেখেছে ঋষি।
তিথি তার কলেজ লাইফ-এর ফ্রেন্ড। বন্ধুত্ব আপন খেয়াল ও নিয়মে কখন যেন আরোও বেশি কিছুর দিকে গড়িয়েছে। দুজনের কেউই তার বহিঃপ্রকাশ দেখায় নি। যে-যার মত ব্যস্ত প্রফেশনাল ওর্য়াল্ড নিয়ে। দেখা হয় মাসে-দুমাসে একবার। ফোন একমাত্র যোগসূত্র।
ছবি আঁকা শেষ হোল প্রায় রাত দেড়টা। ভাল করে দেখে ছবিটার দিকে। গাছের তলায় একটি বেড়াল-বাচ্চা নিয়ে খেলা করছে এক কিশোরী। পরনে ফ্রিল দেওয়া হালকা গোলাপী রঙ-এর ফ্রক। চুলের বেনী দুটিও বেশ পরিস্কার ফুটেছে। মনে-মনে নিজেকে তারিফ করে ঋষি। পুরোনো স্কিলটা না হারানোর আনন্দ। শেখাটা একবার ঠিকঠাক হলে মানুষ কিছুই ভোলে না। এ-যেন সাইকেল চালানো শেখা। সব শেষে দন্ধটা থেকেই যায়- তিতির না গতকালের দেখা যুবতী, মুখের আদলটা ঠিক কার।
দিনের শেষে এক আনন্দ নিয়ে বিছানায় হাত-পা ছড়ায় সে। শরীর আলগা করে গভীর ঘুমে ডুব দেয়।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙে। বেশ হালকা বোধ হয় নিজের। চারপাশে ভাললাগা ঘিরে আছে অনুভব করে। এক-কাপ কফি নিয়ে ছোট্ট ব্যালকনিতে হাজির হয়। এই সময় শহরটা বেশ শান্ত থাকে। সব ধীরে ধীরে জাগছে। গাড়ির গিয়ারটা যেন এক-এ রয়েছে। বেলা বাড়ার সাথে গিয়ার চেঞ্জ-এর সুক্ষ্ম মিল খুঁজে পায় ঋষি। নিজের মনে নিজেই হাসে। অফিসে পা রাখলেই সব ফিলজফি শেষ। সেই বাঁধা গত-এর টার্গেট, ভল্যুম … আর নেটওয়ার্ক। নাহ্, বেশি ভেবে কাজ নেই। সেই রাত্তিরের ট্রাফিক সিগন্যাল-এর রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ফিসফিস করে ভেসে আসা ইংরেজি শব্দগুলি রিলেট করার চেষ্টা করে। কিছুই হদিস পায় না।
অফিস পৌঁছতেই শুরু হয় ব্যস্ততা। নানা কাজের ফাঁকে কোথায় হারিয়ে যায় তিতলি ও এক ঝলকের দেখা যুবতী! মাঝে একদিনের ব্রেক। তারপর টানা ট্যুর। এই ট্যুরগুলি বেশ এনজয় করা যায়। ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। বিভিন্ন ব্যবহার। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু আব্দার থেকেই যায়। সকলের সাথে মিষ্টি সম্পর্ক রেখে কাজ উদ্ধার এক বিশেষ আর্ট তা রপ্ত করেছিল স্নেহাঞ্জন-দার কাছ থেকে। জয়েন করেছিল তার আন্ডারেই। প্রথম ট্যুর-এর শিক্ষা ছিল- কোনও চালাকি করবি না। মনে রাখিস তোর সহজ সরল রুপটাই তোর ব্রান্ডিং। ব্যাবসায়ী মানুষেরা সহজে মন পড়তে পারে। তুই বেঁকলে, ওরাও বেঁকবে।
বেদবাক্য মেনেছিল সিনিয়র-এর কথাকে। তার ফল পেয়েছে হাতে-নাতে। তার জোন-এ কখনও সেল পড়ে নি। চেক-ও বাউন্স করে নি। আজও স্নেহাঞ্জন-দার সাথে সম্পর্কটা একই রকম রয়েছে। যে কোনও বিষয়ে তার ওপর আস্থা রাখা যায়।
তিতির-এর বিষয়টা স্নেহাঞ্জন-দার সাথে ডিসকাস্ করলে হয়। হোটেলে শুয়ে এই চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিথির ফোন চিন্তার সূত্রগুলো ছিঁড়ে দিল।
- হাই, ট্যুর কেমন চলছে।
- অ্যাজ ইউস্যুয়াল। আমায় ক্লায়েন্ট কখনও ধোঁকা দেয় নি।
- একটা গুড নিউজ আছে।
- হেই, আগে পার্টি, পরে নিউজ।
- কিসের পার্টি?
- ঐ যে গুড নিউজ।
- মাই ডিয়ার, কোম্পানি মালয়েশিয়ায় একটা ব্রাঞ্চ খুলছে। অফার আছে যাওয়ার। পে প্যাকেজ অনেক বেশি দেবে।
- হাউ মাচ মানি ডু ইউ নিড তিথি?
- লুক আ অ্যাম গ্রিডি অ্যাবাউট মানি। বলে হোঃ হোঃ করে হাসতে থাকে। প্রাণখোলা এই হাসিটায় তিথির প্লাস পয়েন্ট। যে কোনও মানুষের জীবনিশক্তি বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
ফোনে অনেকটায় সময় কাটায় দুজনে। তিথি ফোন ধরলে আর ছাড়তে চায় না। ঋষির জীবনে ক্রাইসিস পিরিয়ড অর্থাৎ সেকেন্ড সেমিস্টার-এ ব্যাকলগ-এর পর সম্পর্ক আরোও গভীর হয়। ভীষন সাপোর্ট দিয়েছিল সে সময়। আগলে রাখার ব্যাপারে তিথির জুড়ি মেলা ভার। হস্টেল লাইফ-এ বুঝতেই দেয় নি বাড়ির অভাব। এমনকি মায়ের সাথেও দারুণ বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছে। এই যে মালয়েশিয়ার অফিসের কথা পাড়ল শুধুই ক্ষেপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
ঋষি মনটা বসায় মোবাইল-এ লোড করা গানগুলোতে। ভাল করে সিগন্যাল-এ শোনা গানটা আবার শুনতে হবে। এটুকু অনুভব করে- গানটিতে মিলনের ব্যাকুলতা লুকিয়ে আছে। সেখানেই ধন্ধটা লাগে- ফিসফিস করে কানের কাছে ভেসে আসা শব্দগুলির মর্মার্থ- সমর্পন। একটা কারন হলে, অপরটা ফল। বিছানায় শুয়েই ল্যাপটপটা টানে। ফেসবুক খুলতে গিয়েও সংযমী হয়। হোটেলের ইন্টারকম-এ গ্রিলড্ চিকেনের অর্ডার প্লেস করে। বোঝে মানসিক অস্থিরতাই ক্ষিদের কারন। ছেলেবেলায় মায়ের বহু ব্যাবহৃত শব্দটা মনে পড়ে- দুষ্টু ক্ষিদে।
ঘন্টা-খানিক বাদে রুম-এর চেহারাটা দেখার মত। বেডের পাশে গ্রিলড্ চিকেন, একপাশে ল্যাপটপ, সেন্টার টেবিলে খোলা ব্যাগ; আর বিছানায় চিতপাৎ ঋষি, কানে মোবাইল-এর ইয়ারফোন গোঁজা, চোখ দুটি বন্ধ।
দেহটা বিছানায় থাকলেও মনটা ভেসে চলে কল্পনার জগৎ-এ। এ-যেন এক হারানো স্মৃতি উদ্ধারের অভিযান। এক ঝলক-এর দেখা মুখ এত বাঙ্ময় হতে পারে অধরা রয়ে যেত শুধু গানটি না থাকলে। হারিয়ে যায় গানটির কথা, লয়, তাল-এর সাথে। ঘুম ভাঙে পরদিন রুম সার্ভিস-এর ডাকে।
দ্রুত রেডি হয়। আজ ট্যুর-এর শেষ দিন। সব ঠিকঠাক মিটে গেলে ভল্যুম পেরিয়ে যাবে। অর্থাত নেক্স্ট মানথ্-এ টার্গেট বাড়বে। আয়নায় চুল ঠিক করতে-করতে কাঁধ ঝাঁকায় নিজের খেয়ালে। ভাবটা ডোন্ট কেয়ার। বাথরুমে গায়ে জল ঢালতে-ঢালতেই প্রমিস করেছে- আর নয়, অনেক হয়েছে। নো আবেগ, নো তিতির, নো ডাউন দা মেমরি লেন। বহু আগে পড়া লাইনই জীবনের সার- অ্যান্ড স্টিল দেয়ার ইজ বেয়ন্ড ….।
বিকেলের মধ্যে সব কাজ শেষ। রিল্যাক্স্ড মুডেই ট্যুর থেকে ব্যাক করছে। এয়ারপোর্ট থেকে কুল-ক্যাব হায়ার করা তার অভ্যাস। কমপ্লেক্স-এর আগের টার্নিং-এ গাড়ি দাড় করায় একটা কোল্ড-ড্রিঙ্ক্স-এর দোকানের পাশে। নজর পড়ে সামনের ফুটপাতে। সেই রাতের সহজ সরল নিষ্পাপ মুখ হাতে-হাত রেখে এগিয়ে চলেছে এক যুবকের সাথে। দরজা খুলে গাড়িতে ফের বসে। গভীর এক শ্বাস নিয়ে ড্রাইভারকে এগোতে বলে।
কল্পনার ঝাঁপি বন্ধ করে ঋষি। উপলব্ধি হয়; সহজ, সরল, নিষ্পাপ মুখ ও আধুনিকতা পরস্পর বিরোধী নয়। বোঝে, তিতির তার সময় পথের অতীত। মোবাইলটা হাতে তুলে নেয় –
- তিথি, আই নিড টু মিট ইউ টুমরো……….. ।
Comments